ঢাকা,শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

চকরিয়া সুন্দরবনের গুলদিয়ায়  বনবিভাগ ও পুলিশের যৌথ অভিযান: আটক-৩, ৩টি স্কেভেটরে আগুন- ভাংচুর

মনির আহমদ, চকরিয়া অফিস ::   চট্টগ্রামের উপকূলীয় বন বিভাগের আওতাধীন গোরকগাটা রেঞ্জের জেম ঘাট বন বিটের অধীন চকরিয়া সুন্দরবনের প্যারাবন কেটে চিংড়ী ঘের তৈরী কালে অভিযান চালিয়ে ৩ ব্যক্তিকে আটক সহ ৩টি স্কেভেটার গাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ও ভাংচুর করে সফল অভিযান সম্পন্ন করেছে
বনবিভাগ।আজ ২৭ এপ্রিল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টানা অভিযানে বন কর্মি ও একদল পুলিশের সহযোগীতায় নেতৃত্ব দেন উপকুলীয় বনবিভাগের সহকারী বনসংরক্ষক হারিসুল ইসলাম ও রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হক সহ দুই শতাধিক লোক।
জানা যায়, কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটা উপকুল রেঞ্জের আওতাধীন শাপলাপুর চ্যানেলের পূর্ব পাশে চকরিয়ার চরণদ্বীপ ও রামপুর মৌজায় গড়ে উঠেছে ৫ হাজার একর প্যারাবন। এ প্যারাবন রক্ষার দায়িত্ব রয়েছেন জেএমঘাট বনবিট। এ এলাকার প্যারাবনের দিকে কু দৃষ্টি পড়ে চকরিয়া-পেকুয়া ভিত্তিক ভুমিদস্যু সিন্ডিকেট প্রধান চকরিয়ার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের দপ্তরবিহীন নব্য আওয়ামীলীগার জামাল চৌধুরীর। চকরিয়ার পুর্ববড় ভেওলা বিএনপির সভাপতি সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল কাদের এবং শাফলাপুরের রসিদ মেম্বারকে নিয়ে একটি দখলবাজ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন জামাল চৌধুরী। গেল একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পর ওই সিন্ডিকেট উক্ত প্যারাবনের উপর চালায় নিধন-যজ্ঞ। অভিযোগ উঠেছে চকরিয়ার জামাল চৌধুরী, পুর্ববড় ভেওলা বিএনপির সভাপতি সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল কাদের, শাওন চৌধুরী, মহেশখালী শাপলাপুরের রসিদ মেম্বারসহ চকরিয়ার সংঘবদ্ধ প্রভাবশালী দখলবাজ গত ২মাস ধরে ১০/১২টি স্কেভেটর গাড়ি দিয়ে মাটি কেটে সম্প্রতি ২ হাজার একর প্যরাবন কেটে চিংড়ি ঘের নির্মাণ করেছে। পাশাপাশি আরো কয়েকটি ঘের নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে। নির্মাণাধীন ঘেরে রাত দিন পাহারা দিচ্ছে শাপলাপুরের ৬নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ছৈয়দ আলম, প্রকাশ পুরাইয়ার পুত্র জালাল, জহির, আলমগীর, নাছিরের পুত্র এনাম, মৌলভী কাটার মুজিব ও তোফাইল।

এ ছাড়া প্যারাবন কাটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন শাপলাপুরের মনজুর, লাল মিয়ার পুত্র সেলিম, নুরুল ইসলামের পুত্র জসিম উদ্দিন, মৌলভী কাটার মুকতুল ও রায়হান প্রমুখ। এ নিয়ে চকরিয়া নিউজসহ বিভিন্ন পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংবাদ প্রচার হবার পর বন বিভাগের টনক নড়ে। এমনকি জেএমঘাট বন বিট অফিসার নুরুল হোছাইন চৌধুরী সঙ্গীয় বন কর্মীদের নিয়ে অভিযানে গেলে সন্ত্রাসীদের ধাওয়ার মুখে পিচু হটতে বাধ্য হয়।

সর্বশেষ চট্টগ্রাম উপকূলীয় বিভাগীয় বন কর্মকর্তার নির্দেশে এসিএফ হারিসুল ইসলাম, গোরকঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান শতাধিক বন কর্মী এবং চকরিয়া ও মহেশখালী থানার একদল পুলিশ নিয়ে উক্ত প্যারাবনে ২৭ এপ্রিল সকালে অভিযানে নামে। প্রথমে ২ শতাধিক সন্ত্রাসী তাদেরকে বাঁধা দিলেও পরে বন বিভাগ আর পুলিশের তুমুল প্রতিরোধের মুখে সন্ত্রাসীরা পিছু হটে। এ সময় জামাল চৌধুরী গংদের ফেলে যাওয়া মাটি কাটার ৩টি স্কেভেটর গাড়িতে পেট্রোল দিয়ে আগুন দিয়ে ও ভেঙ্গে তছনছ করে দেয় ক্ষুব্ধ লোকজন। এ সময় ধাওয়া করে মোহাং শহিদ, এওশান ও ওসমান নামের
৩ জন স্কেভেটার শ্রমিককে আটক করতে সক্ষম হন। আটক ৩জনের ২ জনের বাড়ী পেকুয়ায় এবং অপরজনের বাড়ী চট্টগ্রাম বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গেছে।
এ বিষয়ে গোরকঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হক অভিযানের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন আটককৃত এবং প্যারাবনে ঘের নির্মাণকারী জামাল চৌধুরী ও পুর্ববড় ভেওলা বিএনপির সভাপতি সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল কাদেরসহ ৫ জনের বিরোদ্ধে গত ২৬ এপ্রিল বন আইনে একটি মামলা করা হয়েছে। এবং ২৭ এপ্রিল শনিবারের অভিযানে আটককৃত ও জড়িতদের বিরোদ্ধে আরো পৃথক পৃথক মামলা প্রস্তুতি চলছে বলে জানান।
ঘটনার সাথে জড়িত চিংড়ী ঘের তৈরীর নেতৃত্বদানকারী কথিত নব্য আওয়ামীলীগ নেতা জামাল চৌধুরীর সাথে মোবাইলে জানতে চাইলে তিনি জানান, প্যারাবনের জায়গার উপর ২০ টি চিংড়ী ঘেরের প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই সব প্রস্তাবের মধ্যে জেলা আওয়ামীলীগ নেতা, উপজেলা আ.লীগ নেতা, উপজেলা চেয়ারম্যান, এমপিসহ অন্তত ১০ জন নেতাকে দেয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে যাদের নামে চিংড়ী ঘের দেয়া হবে তারা জানেন কিনা জানতে চাইলে কথিত জামাল চৌধুরী এ ব্যাপারে সঠিক কোন উত্তর দিতে পারেন নাই।
তবে চিংড়ী জমির দখল-কাগজ কমপ্লিট হলে তাদের পরে জানানো হবে বলে তিনি জানান।

এ প্রসঙ্গে উপকূলীয় বন বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এস এম গোলাম মওলা চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে চকরিয়া সুন্দরবন এলাকার উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী গোলদিয়ারচর ও চরণদ্বীপ মৌজায় প্যারাবন উজাড় ধরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় প্রভাবশালী দখলবাজরা। তারা সেখানে কয়েক লাখ কেওড়া ও বাইন প্রজাতির গাছ কেটে এবং চকরিয়া সুন্দরবনের শাখা খালে মাটির বাঁধ দিয়ে অবৈধভাবে চিংড়িঘের তৈরি করছিল। এ ঘটনা জানার পর পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সহায়তায় উপকূলীয় বন বিভাগ শনিবার অভিযান চালায়। এ সময় খালে দেওয়া মাটির বাঁধ অপসারণ করে শাখা খালগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আটক করা হয় তিনজনকে। যারা সেখানে স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে বাঁধ তৈরি করছিল।’

তিনি অভিযোগ করেন, অভিযান শেষ করে পুলিশ ও কোস্টগার্ডসহ উপকূলীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চলে আসার পর সেখানে দখলবাজরা ফের গিয়ে তাদেরই একটি স্কেভেটরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর পর চকরিয়ার প্রভাবশালী এক জনপ্রতিনিধি তাকে মুঠোফোনে হুমকি দেন স্কেভেটরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করার।

গোরকঘাটা ও চরণদ্বীপ উপকূলীয় বনরেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হক অভিযোগ করে চকরিয়া নিউজকে বলেন, চকরিয়ার প্রভাবশালী এক জনপ্রতিনিধির নির্দেশে চিরিঙ্গা ইউনিয়নের জামাল চৌধুরীর নেতৃত্বে উপকূলের প্যারাবনে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে।

চকরিয়া থানার ওসি মো. বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘উপকূলীয় বন বিভাগের পক্ষ থেকে দেওয়া লিখিত অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে।’

পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘চকরিয়া সুন্দরবনের গোলদিয়ার চর ও চরণদ্বীপ মৌজায় দেড় হাজার একরের বেশি প্যারাবনে পাঁচ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি বাইন ও কেওড়াগাছ ছিল। ইতোমধ্যে তিন লাখের বেশি গাছ কেটে চিংড়িঘের করা হয়েছে।’

পাঠকের মতামত: